ভাত না খেয়ে ৩২ বছর পার করলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরজিৎ দাশ


কে এম রাজীব, চট্টগ্রাম: পৃথিবীতে এখনও এমন মানুষ আছে যারা অন্যের কষ্ট দেখে নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়ে কষ্টকে সঙ্গী করে তা সুখ ভেবে জীবন কাটিয়ে দেয়। অনেকে আবার মানবিক হয়ে নিজের উপার্জিত অর্থ অসহায়দের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে নিজেকে সুখী মনে করেন। তেমনি অনাহারী অসহায়দের কষ্ট মেনে নিতে না পেরে অভিমান করে জীবনের ৬৮ বছরের মধ্য ৩২ টি বছর ভাত না খেয়ে ভাত বিহীন জীবন কাটিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের সম্মানি ভাতা ও নিজের উপার্জিত অর্থ অসহায় অনাহারীদের ভরণ পোষণ ও লেখা পড়ার পিছনে ব্যয় করে যাচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা চির কুমার সুরজিৎ দাশ সুরু।

মুক্তিযোদ্ধা সুরজিৎ দাশ ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও বীর সৈনিক সুরজিৎ দাশের পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলায়। তিনি আনোয়ারা থানাধীন পরৈয়কোড়া ইউনিয়নের পাতোয়া গ্রামের ডা. রমনী মোহন দাশের ছেলে। ডা. রমনী মোহন দাশের বাড়ি আনোয়ারা হলেও পেশাগত দায়িত্ব পালনে পরিবার নিয়ে পূর্ব থেকে বোয়ালখালীর সারোয়াতলী গ্রামে বসবাস করতেন। ওখানে জন্মগ্রহণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরজিৎ দাশ। সুরজিৎ দাশ ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে পরবর্তীতে ১ নং সেক্টরের নিয়ন্ত্রণে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে স্বাধীনতা বিরোধীদের রুখতে এবং দেশকে হানাদার মুক্ত করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে, একটি লাল সবুজের পতাকার প্রত্যাশায় যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন।

বত্রিশ বছর ভাত না খেয়ে থাকার কারণ জানতে চাইলে সুরজিৎ দাশ বলেন, আমরা বাসা বাড়িতে বসে পরিবার পরিজন নিয়ে খুব আনন্দে পেট ভরে ভাত খাচ্ছি। কিন্তু একদিন দেখতে পেলাম দিনের পর দিন না খেয়ে থাকা পথশিশুরা ফেলে দেওয়া খাবার গুলো ময়লার স্তুুপ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আনন্দে ভাগাভাগি করে খাচ্ছে। সে দৃশ্য আমার চোখে পড়ার পর আমি আর ভাত খাবোনা বলে সিদ্ধান্ত নিই এবং ওই দিন থেকে আমি ভাত খাওয়া বন্ধ করে দিই। পরবর্তীতে আমি আমার সামর্থ অনুযায়ী আমার মুক্তিযুদ্ধের সম্মানি ভাতা ও আয়কৃত টাকাসহ মিলিয়ে আমি নিজে না খেয়ে অসহায়দের পিছনে ব্যয় করি। কারণ ওদের সুখে আমি সুখী, ওরা খেলে আমার পেট ভরে। তিনি বলেন, আমার বাবা একজন চিকিৎসক ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন বাবা মানুষের সেবা করে গেছেন। অনাহারে থাকা কোনো মানুষের কষ্ট বাবা মেনে নিতে পারতেন না। প্রতিনিয়তে বাবা তাদের খোঁজ খবর রাখতেন। তখনও অর্থনৈতিক কষ্ট আমাদের গ্রাস করতে পারেনি। আমি তখন কিশোর। অভাব অনুভব করতে পারিনি। বাবা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের খাবার দিয়ে আসতেন। তাই বাবার আদর্শকে বুকে ধারণ করে আমি পথ চলছি।

বীর সৈনিক সুরজিৎ দাশ আরও বলেন, আমি দেখেছি গ্রামে যারা অর্থের অভাবে লেখা পড়া করতে পারতেন না বাবা তাদের লেখা পড়া সহ তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতেন। তেমনি আমি বাবাকে স্মরণ করে বাবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমার মুক্তিযুদ্ধের সম্মানি ভাতা এবং নিজের কিছু আয়ের টাকাতে তিন চারজন ছেলে মেয়েকে লেখা পড়া সহ তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব আমি পালন করি। তাদের সুখে আমার সুখ। জীবনের ৬৮ টি বছর পার করেছি। আমার কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। আমার নেই পরিবার। বর্তমানে আমি কোতোয়ালি থানাধীন দেওয়ানজী পুকুর পাড় এলাকায় আমার বড় বোনের বাড়িতে ভাগিনা, ভাগিনার বৌ, নাতি নাতনি নিয়ে সময় পার করছি। বাকি সময় কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক পাড়া চেরাগি এলাকায় সময় পার করে যাচ্ছি। এতে আমার কোনো অসুবিধা হয় না। বাকি সময় যেন এভাবে পার করে যেতে পারি সবার কাছে সে আশীর্বাদ কামনা করি।


আরও পড়ুন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.