মার্শাল আর্টকে জনপ্রিয় করার একমাত্র মাধ্যম চলচ্চিত্র: ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম
কে এম রাজীব : বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে মার্শাল আর্ট মানেই ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম। আর মার্শাল আর্ট হলো প্রতিপক্ষকে খালি হাতে যুদ্ধ করে পরাজিত করার কলাকৌশল। যা ৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় সন্ন্যাসী ” বোধিধর্মা ” চীনের শাওলিন মন্দিরে এলাকায় আত্নরক্ষার প্রয়োগিক পদ্ধতির মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার কৌশল আবিস্কার করেন। পরবর্তীতে এই কলাকৌশলই মার্শাল আর্ট রূপে পরিচিতি লাভ করে সারাবিশ্বে। এভাবে আস্তে আস্তে মার্শাল আর্ট ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। শুরু হয় এ আত্নরক্ষা পদ্ধতির প্রশিক্ষণ।
একসময় আত্মরক্ষার এই জনপ্রিয় মাধ্যম মার্শাল আর্টের উপর ভিত্তি করে বিদেশে নির্মিত হতে থাকে অসংখ্য চলচ্চিত্র। যার মধ্যে বিশ্বের সেরা মার্শাল আর্ট তারকা ব্রুসলীর মার্শাল আর্ট ভিত্তিক মারপিটের দৃশ্যের চলচ্চিত্র গুলো মানুষ সিনেমা হলে গিয়ে দেখতেন শুরু করেন। তখন আমাদের দেশের মানুষ মার্শাল আর্ট সম্পর্কে ততটাও জানতেন না। পরবর্তীতে সারাবিশ্বের মতো নিজের মাতৃভূমিতেও মার্শাল আর্টকে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে আসেন বার্মা’র প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বাংলাদেশের ছেলে ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম। তাঁর উদ্যোগে বাংলাদেশে গড়ে ওঠে প্রায় ৬০০’র মতো মার্শাল আর্ট স্কুল। প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ফাইটার ক্যারাতে ক্লাব। ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম চট্টগ্রামে মার্শাল আর্টের স্কুল প্রতিষ্ঠা করার পর মানুষ মার্শাল আর্ট সম্পর্কে জানতে পারে এবং এ শিল্পকে পরিচিত করতে থাকেন গ্র্যান্ড মাস্টার ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম।
ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম মার্শাল আর্টে বার্মা’র প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হলেও মূলত তিনি চট্টগ্রাম কক্সবাজারের উখিয়ার সন্তান। তিনি চট্টগ্রামে মার্শাল আর্টের স্কুল প্রতিষ্ঠা করার পর একসময় তাঁর সাথে পরিচয় হয় ওই সময়ের জনপ্রিয় ড্যাসিং হিরো, পরিচালক, প্রযোজক বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুদ পারভেজ সোহেল রানার সাথে। পরিচয়ের সূত্রে সোহেল রানা তাঁকে চলচ্চিত্রে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান।পরে তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ঢাকায় চলে যান। সেখানে সোহেল রানা নিজেই মার্শাল আর্ট শিখেন ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলমের কাছে। এরপর ধীরে ধীরে মার্শাল আর্টকে চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু করান। ৭০ দশকের দিকে মাসুদ পারভেজ এর ” যাদু নগর” ছবির মধ্যে দিয়ে চলচ্চিত্রে আর্বিভাব ঘটে ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলমের। পরবর্তীতে মার্শাল আর্ট শিল্পটি চলচ্চিত্রে জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং একের পর এক মার্শাল আর্টের ছবি নির্মাণ হতে থাকে বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে। জাহাঙ্গীর আলম চলচ্চিত্রে প্রবেশের পর মার্শাল আর্টের প্রতি আসক্ত হয়ে তাঁর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেন লড়াকু নায়ক মাসুম পারভেজ রুবেল, খালিদ মাহমুদ, ড্যানি সিডাক, ইলিয়াছ কাঞ্চন, মিশা সওদাগর, অমিত হাসান সহ আরও অনেকে। জাহাঙ্গীর আলম সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও মার্শাল আর্টকে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জনপ্রিয় করতে ৮০’র দশকে নায়ক সোহেল রানাকে নিয়ে নির্মিত করেন তাঁর প্রথম প্রযোজিত ছবি ‘মার্শাল হিরো’। এরপর চলচ্চিত্রে জোয়ার বইতে থাকে মার্শাল আর্ট সিনেমার এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করেন ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম।
ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলমের উল্লেখযোগ্য ছবি হলো, শরীফ বদমাশ, সিআইডি, লড়াকু, হাইজ্যাক, বিদ্রোহী, মার্শাল হিরো, লিনজা, মাস্টার সামুরাই, ওস্তাদের ওস্তাদ, কুংফু নায়ক, প্রেমিক রংবাজ, মরণ লড়াই, সোহেল রানা, ক্যারাটি মাস্টার, কুংফু কন্যা, ওস্তাদ সাগরেদ, মৃত্যুঘণ্টা, পেশাদার খুনি, সুন্দরী মিস বাংলাদেশ, সাহসী সন্তান, বিদ্রোহী মাস্তান ও লাল চোখ। জাহাঙ্গীর আলমের অভিনয়ের থেকে মার্শাল আর্টকে প্রাধান্য দিতেন বেশি। তাঁর প্রথমদিকের ছবি যেমন ‘শরীফ বদমাশ’-এ ভালো অভিনয় ছিল। তবে তার সেরা ছবি ছিল ‘ মার্শাল হিরো’ ‘মাস্টার সামুরাই ও ‘ ক্যারাটি মাস্টার’। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন সহ বিভিন্ন টিভিতে মার্শাল আর্টের অনুষ্ঠানও করেছেন। ২০০০ সালের পরবর্তী সময়ে কিছু কিছু বাংলা সিনেমায় যখন অশ্লীলতা ভর করে বসে তখন তিনি নিজেকে খানিকটা আড়াল করে নেন চলচ্চিত্র থেকে। তাঁর বিশ্বাস মার্শাল আর্টকে জনপ্রিয় করার একমাত্র সহজ মাধ্যম হচ্ছে চলচ্চিত্র।’
তাই দীর্ঘ বিরতির পর ‘ডিজিটাল প্রেম’ নামের নতুন একটি সিনেমা নিয়ে আবারও চলচ্চিত্রে পথচলা শুরু করেন জাহাঙ্গীর আলম।
চলচ্চিত্র থেকে বিরতি নেওয়া ও নতুন গল্প নিয়ে আবারও সিনেমা নির্মাণ বিষয় জানতে চাইলে অভিনেতা ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বর্তমানে চলচ্চিত্রের ব্যবসা খুব একটা ভালো নেই।বেশির ভাগ সিনেমা হল বন্ধ। যার ফলে মার্শাল আর্ট সিনেমা নির্মাণ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। এখন দেখছি অনেকে নতুন আঙ্গিকে কিছু সিনেমা হল তৈরি করছে। এসব হল গুলোতে দর্শকের উপস্থিতিও দেখা যায়। এতে করে বুঝা যায় সিনেমার দর্শক এখনো আছে। যেহেতু দর্শক আছে সেহেতু ভালো মানের গল্প দিয়ে পরিবার নিয়ে দেখার মতো সিনেমা যদি নির্মাণ করা হয় তাহলে দর্শক অবশ্যই সিনেমা হল মুখি হবে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে
যেহেতু চলচ্চিত্র থেকে অনেক কিছু পেয়েছি, তাই ” ডিজিটাল প্রেম ” নামের নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরতে যাচ্ছি। এর মধ্যে সিনেমার গল্প ও চিত্রনাট্য লেখা শেষ করেছি। এই সিনেমায় আমিও অভিনয় করব। তাছাড়া দুজন নতুন নায়ক নায়িকা থাকবে। সিনেমাটি মার্শাল আর্ট নির্ভর হবে।
তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি যুব সমাজকে অপরাধ ও মাদক মুক্ত করতে হলে বিনোদনের প্রয়োজন আছে। মার্শাল আর্টের সিনেমা মানে বিনোদনের একটি অংশ। আর মার্শাল আর্ট হচ্ছে শারীরিক ভাবে প্রতিপক্ষকে খালি হাতে প্রতিরোধ করার প্রশিক্ষণ। এটা বিশ্বের সব দেশে প্রচলন আছে এবং ওইসব দেশে মার্শাল আর্টের বিদ্যাপীঠও আছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশেও তার ব্যাতিক্রম নই। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় যুবক যুবতী এবং শিক্ষার্থীরা লেখা পড়ার পাশাপাশি মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। মার্শাল আর্ট আমাদের দেশে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আমরা ইতি মধ্যে বাংলাদেশে মার্শাল আর্টের ফাইটার ক্যারাটি ইন্টারন্যাশনালি ভাবে ঢাকা থেকে কার্যক্রম শুরু করেছি এবং এটা বিভাগীয় পর্যায়ে চলতেছে। আগামীতে আরও বৃহত্তর আকারে চলবে। আমি চাই বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায়, প্রতি ঘরে ঘরে নতুন প্রজন্মেরা মার্শাল আর্টের প্রতি উদ্ভুদ্ধ হোক, এতেই আমার স্বার্থকতা এবং সফলতা।
ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলমকে নিয়ে অনেকে অনেক কিছু সমালোচনা করলেও একথাও ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মার্শাল আর্টের প্রতিষ্ঠাতা এবং চলচ্চিত্রে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যাদুকর । তাই তাঁর যোগ্য সম্মানটাও তাঁকে দেওয়াটা উচিত। ব্যক্তিজীবনে জাহাঙ্গীর আলম প্রথম বিয়ে করেন নায়িকা রঞ্জিতাকে। রঞ্জিতার সাথে বিচ্ছেদের পর বিয়ে করেন নায়িকা রাকাকে। বর্তমানে চলচ্চিত্রের পাশাপাশি কক্সবাজার কলাতলীতে একটি রিসোর্ট নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন গ্র্যান্ড মাস্টার ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম।