শুরুর শিল্পটি সুন্দর তবে শেষের শিল্পটি বিবেকের আদালতে : মো. ইউনুছ


সুন্দর বিদায় হলো ক্ষতি না করে বিদায় নেয়া, সুন্দর কথা হলো বকা না দিয়ে ক্ষমা করা, সুন্দর ধৈর্য হলো অভিযোগ না রেখে ধৈর্যধারণ করা। মনীষীর এ বাণী কিংবা বাল্যকালে পাঠশালায় মুখস্ত করা, আর যদি না জাগি মা , কেমনে সকাল হবে ‘ থাকবে নাকো বদ্ধঘরে , দেখবো এবার জাগৎটাকে’ অন্তরের গহীন থেকে উত্থিত শব্দমালাগুলো কখন থেকে বাস্তবতায় মিশে গেলো- জীবনের এ পর্যায়ে এসে ভাবতেই অবাক হচ্ছি। জগৎটাকে একবার নিজের মতো করে দেখার সুযোগ যেন চলমান জীবনে পাই। সে তৃষ্ণায় ভূষিত ছিলো আমার মন। এটি যেন শৈশব – কৈশোরে অনাবিল প্রাপ্তির নেশা। চলমান জীবনটাকে প্রভু সে পথেই নিয়ে গেলো। তবে সবকিছুর উপসংহার চলার পথে ক্লান্তি তার সময়ের ব্যবধানে নতুনের কাছে তুলে দেয়ার অমোঘ নিয়ামের গণ্ডিতেই আমরা, তাই বিদায়টা চিরাচরিত , কর্মেরস্বরূপ সবার কাছে আনন্দের। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। যেমনি চাওয়া তেমনি পাওায়। পদ পদবী ভুলে গিয়ে মানুষের মাঝে মিশে থাকা , ক্রীড়া , বিনোদন , সমাজসেবা , পরোপকার , পীড়িত ও বিপন্ন মানবতায় নিজেকে উজাড় করার সুযোগগুলো অবহেলায় পার করে দিইনি। চেষ্টা করেছি সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আশৈশব লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে। প্রতিষ্ঠানের বেদখল সম্পত্তি ‘ রঙ্গম সিনেমা হল ‘ উদ্ধারে সংশ্লিষ্টদের সাথে বিশেষ ভূমিকা পালনে কালের স্বাক্ষী হয়ে থাকবে। তবে কতটুকু পেরেছি- সময়ই তার বিচার করবে। বিচ্ছিন্নভাবে মানবতার কাজের ফাঁকে সরকারি চাকরির সুবাদে কর্মযোগে যাপিত জীবনে ১৯৯২ সালে যুক্ত হই। শতবর্ষী ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা – কর্মচারীদের প্রাণের সংগঠন কেসিদে ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম নামক প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে।

১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ লাভ করি। তিন বছরের অতি স্বল্পসময়ে সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে এক অনবদ্য কর্মীর মর্যাদায় আবির্ভূত হই। ১৯৯৫ সালে সংগঠনটির ব্যবস্থাপনা কমিটির ক্রীড়া সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হয়। দায়িত্ব পালনকালে ১৯৯৬ সালে বিভাগীয় কমিশনার চট্টগ্রাম জনাব শাখাওয়াত হোসেন মহোদয়কে প্রধান অতিথি করে প্রথমবারের মতো বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সফল আয়োজন করি। সংশ্লিষ্টরা এবার বিনোদনে আস্থা রাখে আমার ওপর। ১৯৯৭ আগে বিনোদন সম্পাদক হয়ে সাংস্কৃতিক আয়োজন ছিলো নজরকাড়া। ১৯৯৯ সালে যুগ্ম – সাধারণ সম্পাদক পদ প্রাপ্তি যেন আমার অতীত কর্মযজ্ঞের দীপশিখা। এক’বছর সকল সদস্যদের কাছে আমার কর্মদক্ষতা যেন এক ভিন্ন বৈশিষ্ট্যরূপে ধরা দিলো। অতঃপর ২০০৮ সাল। সাধারণ সম্পাদনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণের পালায় তুমুল প্রতিযোগীতা বে – শামাল প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সিনিয়র জুনিয়র মিলে সকলেই আমার নেতৃত্বকে জাগিয়ে তুলতে চায়। অশুভ ছায়ায় আমার উত্থান যেন নির্মম না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই সকলে কাজ করলো। অবশেষে ধরা দিলো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ সাধারণ সম্পাদক। এ ছিলো প্রবল অাগ্রহের আবাসস্থলে ভালোবাসার মূল্যায়ন। এবার অবারিত এক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে কিছু পরিকল্পনা কিছু উদ্যোগ গ্রহণ। সংশ্লিষ্ট সকলের মতামতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানে যাদের অবদান রয়েছে এমন গুণীজনদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, সদস্যদের কৃতি সন্তান – সন্ততিদের সংবর্ধনা। ক্রীড়া নৈপুণ্যতা , বিনোদন , বার্ষিক ভ্রমণ ও বনভোজনের প্রতি অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে স্বতঃস্ফূর্ত সম্মিলিত প্রয়াসের ফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে প্রথম বারের মতে ২০০৮ সালে নগরীর মুসলিম ইন্সটিটিউট হল – এ অভিষেক সংবর্ধনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ‘ – এর আয়োজন ছিলো প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সংস্কৃতির লালন ও চর্চার এক মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। এ অনুষ্ঠানে বিভাগীয় কমিশনার চট্টগ্রাম জনাব হোসাইন জামিল মহোদয় ও জেলা প্রশাসক চট্টগ্রাম জনাব মো আশরাফ শামীম মহোদয় মান্যবর প্রধান ও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে সকলের আনন্দ উচ্ছ্বাসকে আরো প্রাণবন্ত করেন।

মূলত তখন থেকেই মঙ্গল সারথীকে সাথে নিয়ে কন্টকাকীর্ণ ও পদে পদে অন্ধত্বের আস্ফালন , সীমাহীন বাঁধাকে উপেক্ষা করে সকল ভেদাভেদ ভুলে সাম্প্রদায়িকতা নীতিহীনতার মতো আরো কতো আঁধার ভাঙ্গার স্বপ্ন নিয়ে আলোর দরজায় প্রবেশ করলাম । এ যেন সুন্দরের এক অনুপম অধ্যায়। কোনো প্রতিষ্ঠান যখন জন্মলগ্ন থেকে চড়াই উৎরাই অতিক্রান্ত হয়ে শতবর্ষের সুবৰ্ণ তোরণে এসে পৌঁছায় তখন এটি হয়ে উঠে সমাজ – সভ্যতার এক ঐতিহ্যসমৃদ্ধ নিকেতন । যুগে যুগে অনেক জ্ঞানী – গুণী মহার্যবৃন্দ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়কে কাজে লাগিয়েছিলেন , শতবর্ষী এই আঙ্গিনাকে আরো সুন্দর সহজভাবে উপস্থাপন করা ছিলে আমার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের একই শৃঙ্খলাবিহীন বিভোরতা। ২০১৫ সালে পতেঙ্গা বোট ক্লাবে জাঁকজমকভাবে শতবার্ষিকী উদযাপনযাপন ছিলো প্রতিষ্ঠানের গৌরব ঐতিহ্যের ধারাকে অব্যাহত রাখার মহাপ্রয়াস।এতে সকল স্ব – স্ব কর্মক্ষেত্র থেকে উদাম ও প্রতিভার স্বাক্ষরে শতাব্দীর স্মারক সাক্ষী হয়ে গেলাম। এ অনুষ্ঠানে খোলা প্রশাসক চট্টগ্রাম জনাব মেজবাহ উদ্দিন মহোদয় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে অনুপ্রেরণা দেন । সে সময়ের প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন আয়োজন এই শতবর্ষী আঙ্গিনাকে প্রাণবন্ত করে রাখবে চিরকাল। আনন্দঘন পরিবেশে শতবর্ষী মিলনমেলা সকলের সরব উপস্থিতি যাপিত জীবনকে আনন্দসময় করে তোলার এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচনে আমাকে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে অভিষিক্ত করেন সতীর্থ শুভাকাঙ্ক্ষীরা।সর্বকালের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে প্রথমে সদস্য ” পরে সভাপতি নির্বাচিত হই। এ যেন আকাশের টুকরো সামিয়ানায় গোলাপী পেখমের চরম পরশ। এটি সৃষ্টির ঘনঘটায় দুর্নিবার আকাংকা।

বিগত ২০১৮ সালে পুনরায় দ্বিতীয় বারের মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি নির্বাচিত করে যারা আমাকে এ পদে পদায়ন করেছেন তাঁদের প্রতি আমার বিন শ্রদ্ধা আর অপার ভালোবাসা । সময়ের সাথে বোঝাপড়ারও একটা নির্দিষ্টতা থাকে। সে সময় পেরিয়ে গেলে চাওয়া পাওয়া হয় সমান্তল। তাই যে কোনো কিছু প্রথমেই সমকালের পরিধির মধ্যে একটা দায় থেকেই থাকে । সেক্ষেত্রে সম্মিলিত প্রয়াসে প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের স্বার্থরক্ষা এবং সুযোগ সুবিধার নির্মিত্তে বেশকিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ১. প্রয়াস শিরোনামে একটি ম্যাগাজিন নিয়মিত প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রক প্রচারের ব্যবস্থা করা। ২. প্রতিবছর জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে আনন্দভ্রমণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। ৩. সকল সদস্যগণের অসুস্থকালীন চিকিৎসা ভাতা প্রচলন। ৪. সদস্যদের মৃত্যুতে এককালীন অনুদান। ৫. সদস্যদের সন্তান – সন্তুতির জন্য শিক্ষাবৃত্তির প্রচলন ও কৃতিসন্তানদের সংবর্ধনা প্রদান। ৬. গর্বিত মাতা – পিতাকে সম্মাননা প্রদান এবং ৭. প্রবীন সদস্যদের বয়স্কভাতা প্রদান । সর্বশেষ রীমা কমিউনিটি সেন্টারের আয়োজন ছিলো মনোমুগ্ধকর। আমার দায়িত্ব পালনকালে প্রতিনিয়ত চিন্তায় মননে ছিলো প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের আর্তসামাজিক ও জীবন মানোন্নয়নের বাহক হোক এ প্রতিষ্ঠান , সে লক্ষ্যে শত বাঁধা ও প্রতিকূলতাকে ডিঙ্গিয়ে কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থরক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা ছিলো অবিরত।তাতে যদি কোথাও আমার ভ্রান্তি ধরা পড়ে তা হবে অজ্ঞাত এবং সীমাবদ্ধতা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এখনো পর্যন্ত অনেক ত্যাগীপুরুষ , বরেণ্য ব্যক্তিত্ব , মানবহিতৈষী হৃদয়বান কর্মকর্তাগণ নানাভাবে কেসিদে ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম এর উন্নয়নে অবদান রেখেছেন । যা দীর্ঘ ইতিহাসে কতিপয় চরম সংকটকাল পেরিয়ে , গৌরবোজ্জ্বল অবদানের ধারা উজ্জীবিত রয়েছে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং অসীম কৃতজ্ঞতা ।

দুই যুগেরও বেশি সময়ে একাধারে এই দায়িত্বগুলো পালন করতে গিয়ে সকল সদস্যগণের পাশাপাশি প্রয়াত আবদুল গফুর চৌধুরী , প্রয়াত খায়রুল বশর চৌধুরী , প্রয়াত জমির উদ্দিন আহমদ চৌধুরী , প্রয়াত নূরুল হক , প্রয়াত বিশ্বনাথ সাহা , প্রয়াত মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন , প্রয়াত মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম , প্রয়াত সামশুদ্দিন আহাম্মদ ও প্রয়াত সামশুল আলম। সর্বজনাব মোহাম্মদ ছৈয়দ আহমদ, সমীর রঞ্জন ঘোষ, এ.এম.এম জাহাঙ্গীর আলম , মোহাম্মদ শওকত হোসেন , মনোজ কুমার বড়ুয়া , মো . গিয়াস উদ্দিন , মো . গোলাম মহিউদ্দিন মাহমুদ – সহ অনেকে বিভিন্ন রভাবে আমাকে সুনিপুণভাবে প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করেছেন। সেই সুযোগে প্রতিষ্ঠানের অনেক কাজই সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে । তবে কিছু কিছু পরিকল্পনা নানা জটিলতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে শেষ করা সম্ভব হয়নি । ফলে আশাবাদী নতুন নেতৃত্ব যেন অসমাপ্ত কাজগুলোর নিয়ে অগ্রগামী হয় সে প্রত্যশা বারংবার। তাই বলবো- বিদায় মানেই কষ্ট নয় , কিছু কিছু সময় বিদায় মানে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তিযোগে আরো ভালো কিছুর সুযোগ করে দেয়া।

লেখক: মোহাম্মদ ইউনুছ, সভাপতি কেসিদে ইনিস্টিটিউট, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, চট্টগ্রাম।


আরও পড়ুন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.