চট্টগ্রামে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন
চট্টগ্রাম নগরীতে রোগীর সাথে দুর্ব্যবহার, অবহেলা এবং ভুল চিকিৎসার মাধ্যমে ডায়ালাইসিস গ্রহণকারীর সাফিয়া খানম ৬০ বছর বয়সী এক কিডনি জনিত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন স্যান্ডর ডায়ালাইসিস সার্ভিসেস বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড নামক একটি প্রাইভেট হাসপাতালের ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলন করেছেন মৃত ব্যক্তির পরিবার।
বুধবার (১৫ জুন) সকাল ১১ টায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের এস রহমান হলে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মৃত সাদিয়া খানমের স্বামী এম এ মাসুদ।
এসময় তিনি বলেন, আমার স্ত্রী সাফিয়া খানম ৬০ বছর বয়সের কিডনী ও ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত একজন গৃহবধু। কিডনী রোগের জন্য আমার স্ত্রীকে প্রতি সপ্তাহে রোববার এবং বুধবার ডায়ালাইসিস নিতে হত। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রধান প্রবেশ পথের ডান পাশে (পশ্চিম পাশে) অবস্থিত স্যানডর ডায়ালাইসিস সেন্টারে প্রতি সপ্তাহের এই দুই দিন রাত ৯টায় ডায়ালাইসিসের জন্য আমার স্ত্রীকে এই সেন্টার আসতে হত। আমার পুত্র তানভীর আহমেদ এবং আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে থাকতাম। গত ৫ জুন রোববার রাত ৯টায় ডায়ালাইসিসের জন্য তাঁকে নিয়ে আমার ছেলে উক্ত সেন্টারে উপস্থিত হয়। রাত ১০.২০ মিনিটের সময় ডায়ালাইসিসে জন্য তাঁকে বেডে শোয়ানো হয়। এই তারিখের আগে যতবার ডায়ালাইসিস করা হয়েছে ততবার মহিলা নার্স/টেকনিশিয়ান দিয়ে ডায়ালাইসিস শুরু করা হতো। কিন্তু সেদিন ‘জয়’ নামের একজন পুরুষ টেকনিশিয়ান দিয়ে তাঁর ডায়ালাইসিস শুরু করা হয়। আমার স্ত্রী এবং আমার ছেলে উপস্থিত মহিলা টেকনিশিয়ানকে দিয়ে ডায়ালাইসিস শুরু করার জন্য বারবার অনুরোধ করলেও তাদের অনুরোধ রক্ষা করা হয়নি। বরং আমার স্ত্রী ও ছেলের সাথে উক্ত নার্স/টেকনিশিয়ান অভদ্র আচরণ করে এবং আমার স্ত্রীর ডায়ালাইসিস শুরু করতে অস্বীকার করে। অভদ্র আচরণের মাধ্যমে আমার স্ত্রীকে ও ছেলেকে অপমানিত করে আমার স্ত্রী তথা রোগীর ইচ্ছার বিরুরদ্ধে পুরুষ টেকনিশিয়ান ‘জয়’ কে দিয়ে ডায়ালাইলিসস শুরু করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ডায়ালাইসিস শুরু করার ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে আমার স্ত্রীর প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। সেখানে কর্তব্যরত নার্স এবং চিকিৎসক ডাক্তার রেহনুমাকে আমার ছেলে তানভীর আহমেদ তার মায়ের (আমার স্ত্রীর) শ্বাাসকষ্টের কথা অবহিত করলে ডাক্তার রেহনুমা ধমক দিয়ে বলেন : “রোগীকে যে রক্ত দিতে হবে তা আপনারা জানেন না ? যান রক্ত জোগাড় করে নিয়ে আসুন।” সেদিন সীতাকুন্ডেের কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নি দুর্ঘটনায় আহতদের জন্য রক্ত দিতে আসা গাউছিয়া কমিটির লোকজন তাদের দেওয়া রক্ত থেকে এক ব্যাগ রক্ত আমার ছেলে তানভীর এবং আমার আত্মীয় রাশেদ খান রাসুকে দিয়ে দেন। তারা রক্ত নিয়ে ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে ডায়ালাইসিস সেন্টারে এসে ডাক্তার রেহনুমাকে রক্ত জোগাড় হওয়ার কথা অবহিত করলে ডাক্তার রেহনুমা রেগে গিয়ে বলেন যে, “রোগীকে এখানে ডায়ালাইসিস দেওয়া সম্ভব নয়, ওনাকে অন্য কোন হাসপাতালে নিয়ে যান। ওনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৭২, আমি রিস্ক নিতে পারব না।” রেহনুমার এই হটকারি সিদ্ধান্তের সাথে জোরালো সমর্থন দেয় উপস্থিত নার্স ও টেকনিশিয়ানগণ।
একথা বলার পর ডাক্তার রেহনুমা আমার স্ত্রীর অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলেন এবং উপস্থিত নার্সদের আমার স্ত্রীকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে বাইরে নিয়ে যেতে বলেন। আমার ছেলে তানভীর, আমার আত্মীয় জাশেদ খান জাসু প্রচন্ড শ্বাস -কষ্ট হওয়া একজন রোগীকে অক্সিজেন ছাড়া কিভাবে অন্যত্র নিয়ে যেতে বলেন সে প্রশ্ন করলে ডাক্তার রেহনুমা অত্যন্ত রেগে যান। আমার পুত্র ডাক্তার রেহনুমাকে বারবার অনুরোধ করে বলে যে অন্তত: একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে এবং আমার স্ত্রীর মুখে মাস্ক লাগিয়ে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোন মেডিসিন ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হোক। ডাক্তার রেহনুমা এতে কর্ণপাত করেননি। ডাক্তার রেহনুমা অক্সিজেনের অভাবে কষ্ট পাওয়া একজন রোগীকে ডায়ালাইসিস সেন্টার থেকে বাইরে নিয়ে যেতে উপস্থিত তার অধীনস্থ নার্স/স্টাফদের নির্দেশ দেন। আমার স্ত্রীকে যখন হুইল চেয়ারে করে ডায়ালাইসিস সেন্টারের বাইরে আনা হয় তখন আমি এবং আমার কন্যা সেখানে গিয়ে পৌঁছি।
স্যানডর ডায়লাইসিস কর্তৃপক্ষ, ডাক্তার রেহনুমা, নার্স, টেকনিশিয়ানদের এমন অমানবিক আচরণ ও দুর্ব্যবহারে পরিপ্রেক্ষিতে ডায়ালাইিসিস করতে আসা রোগীদের স্বজনরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা সহ আমার ছেলে তানভীর, আত্মীয় জাসেদ খান জাসু, কন্যা তামান্না তানজিন এবং আমি হুইল চেয়ার ঠেলে হাসপাতালের প্রধান ফটকের বাইরে নিয়ে আসি। তখন হুইল চেয়ারে বসা আমার স্ত্রীর শরীর নেতিয়ে পড়ে এবং তার মুখ থেকে ফেনা বের হয়। আমরা দ্রুত একটি সিএনজি চালিত অটো রিক্সা নিয়ে নিকটস্থ পার্কভিউ হাসপাতালে ইমার্জেন্সীতে নিয়ে আসি। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তারগণ আমার স্ত্রীকে মৃত ঘোষণা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্যে রোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে রোগীর এই মৃত্যুকে হত্যাকান্ড হিসেবে অবহিত করা হয় এবং এর জন্য ‘স্যান্ডর কর্তৃপক্ষ এবং ডাক্তার রেহনুমার’ বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী জানানো হয়। এসময় স্যান্ডর কর্তৃপক্ষের সাথে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চুক্তি বাতিল করে এই ডায়ালাইসিস কেন্দ্রটি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কিডনী বিভাগের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য প্রয়াত রোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে জোর দাবী জানান রোগীর স্বামী এম.এ মাসুদ।একপর্যায়ে নিহতের স্বজনরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
তাঁরা প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, ডিজি হেলথ, পুলিশের মহাপরিদর্শক, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বি.এম.এ), স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ), চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনসহ সকলের প্রতি এই ঘটনার বিষয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী জানান।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, এম এ মাসুদের ছেলে সাংবাদিক তানভীর আহামদ, মেয়ে তামান্না তানভীর, ছোট ভাইয়ের স্ত্রী আফরোজা পারভিন, আত্নীয় আবু বক্কর চৌধুরী ও জাশেদ খান।